প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস

১৯৭৪ সালে একদল আলোকিত ও আত্মনিবেদিত সমাজ হিতৈষী বৌদ্ধ ভিক্ষু কর্তৃক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মোনঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। মোনঘর প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিলো পার্বত্য অঞ্চলের অনাথ অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করে তাদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। মোনঘরের সংবিধানে বর্ণিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিপূরণের লক্ষ্যে মোনঘর শিশুসদনে আশ্রিত অনাথ ও দু:স্থ শিশুদের মাঝে শিক্ষা দানের জন্যে ১৯৮০ সালে মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮২ সালে এটি তৎকালীন কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৫ সালে মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।

মাত্র ১০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৮২ সালের ১ জানুয়ারী থেকে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। তাদের মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩০। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বিদ্যালয়ের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। প্রতি বছর বাড়ছে। শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যাও বেড়েছে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে শিক্ষক কর্মচারীর সংখ্যাও বাড়াতে হবে।

বলা বাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভৌগলিকভাবে অত্যন্ত দুর্গম। অনেক জায়গায় বিদ্যালয় নেই। অনেক জায়গায় বিদ্যালয় থাকলেও পর্যাপ্ত শিক্ষক ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নেই। ’সরকারের সবার aজন্য প্রাথমিক শিক্ষা’ নীতির কারণে বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলেও বিভিন্ন জায়গায় প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনো জুমিয়া পরিবারের অনেক শিশু শিক্ষা সুযোগের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। এছাড়া কোন মতে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করতে পারলেও অনেক শিক্ষার্থী নিম্ন মাধ্যমিক অথবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো গ্রামের কাছাকাছি নিম্ন মাধ্যমিক অথবা মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকা। অন্যদিকে পার্বত্য অঞ্চলে আবাসিক বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা নেই। দারিদ্র্যের কারণে অনেক অভিভাবকের পক্ষেও উপজেলা বা জেলা সদরে লজিং বা ঘর ভাড়া করে ছেলেমেয়ে পড়ানো সম্ভব হয় না। দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় এই সমস্যা মেয়েদের জন্যে আরো বেশি প্রকট। এই অবস্থায় আবাসিক বিদ্যালয় হিসেবে মোনঘরই অনেক অভিভাবকের কাছে তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার একমাত্র ভরসা স্থল।

তিন পার্বত্য জেলা থেকে সব জাতিগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েরা মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে পড়তে আসে। বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রান্তিক ছেলে-মেয়েরা মোনঘরে ভর্তি হতে আসে। দেখা গেছে, এসব ছেলে-মেয়ের যেমন ভাষাগত সমস্যা রয়েছে, তেমনি ঘাটতি রয়েছে তাদের প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনে। দারিদ্র্য তো আছেই। এসব সমস্যা মোকাবিলা করে শিক্ষকমন্ডলী ও মোনঘরের সংশ্লিষ্ট সকল কর্মী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের পেছনে তারা মেধা ও শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।

দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের কথা বিবেচনায় নিলে মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের অর্জন কম নয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখান থেকে চার হাজারের অধিক শিক্ষার্থী পাস করে বের হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত আছেন। তাদের অনেকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবি, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও সরকারী প্রশাসনে প্রশাসক হিসেবে মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তারা সমাজ ও দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।

যুগের পরিবর্তন ও চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যালয়কে একটি আধুনিক ও যুগোপোযোগী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে এবং সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

 

বিদ্যালয়ের রূপকল্প

 

দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় বিদ্যালয় হিসেবে পরিপূর্ণ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনন ও হৃদয়বৃত্তির বিকাশ ঘটানো।

বিদ্যালয়ের বাণী: পঞ্ঞা বুডঢিযা বডঢিস্সামা তি  (আমাদের শিক্ষায় করিব প্রজ্ঞার সাধনা)।

 

বিদ্যালয়ের অভিলক্ষ্য

 

আমরা শিশুদের বিশেষ করে সুবিধা বঞ্চিতদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ ও কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৃহত্তর পরিসরে জনগণকে সম্পৃক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। আমাদের রূপকল্প অর্জনের লক্ষ্যে আমরা

  • সহভাগিতা ও সেবাযত্নমূলক পরিবেশে শিশুকেন্দ্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পরিপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করি;
  • মনন ও হৃদয়বৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশে উদ্যমী হতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করি;
  • শিক্ষার্থীর নিজের ও অন্য সবার সুখের জন্য প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অন্বেষণ করতে অধ্যবসায়ী হতে শিক্ষাদান করি;
  • নিজেদের একাডেমিক পড়াশুনার গন্ডীর বাইরে সামষ্টিক কল্যাণ ও শান্তির জন্য শিক্ষার্থীদের সামাজিক দায়বদ্ধতার শিক্ষাদান করি।

 

মূল্যবোধ

 

আমরা নিম্নলিখিত মূল্যবোধসমূহ মনের মধ্যে ধারন করি। এ মূল্যবোধসমূহ আমাদের বিদ্যালয়ের ভিত্তি রচনা ও শিখন-শেখানো কার্যক্রমের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে:

  • অহিংসা
  • পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ
  • করুণা
  • অসাম্প্রদায়িকতা (non-sectarianism)
  • স্ব-উদ্যম
  • সামাজিক দায়বদ্ধতা
  • চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা
  • কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ