মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়

স্থাপিত: ১৯৮০ খ্রিঃ. EIIN: 107792, Institute Code: 0410031301
ঠিকানা-রাঙ্গাপানি, রাঙ্গামাটি, ফোন : 0351-61043, ই-মেইল : info@mors.edu.bd

একুশে পদক ২০২২-এ ভূষিত হওয়ায় মোনঘরের প্রতিষ্ঠাতা সদ্ধর্মাদিত্য শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের ভান্তেকে শ্রদ্ধাভিনন্দন

প্রকাশিত হয়েছে: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | পড়া হয়েছে 1089 বার

৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ খ্রিঃ তারিখে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘একুশে পদক ২০২২’ ঘোষণা করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিককে একুশে পদক ২০২২ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাঁদের মধ্যে মোনঘরের প্রতিষ্ঠাতা যিনি গুরুভান্তে হিসেবে সমধিক পরিচিত সদ্ধর্মাদিত্য শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয় অন্যতম। সমাজসেবায় অবদান রাখায় তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হলো। তাঁর এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মাননার জন্য আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। পরম পূজ্য শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের গুরুভান্তের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধাভিনন্দন জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য, পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের নীতি ও আদর্শের সাথে সংগতি রেখে সমাজ সম্পৃক্ততামূলক (Socially engaged Buddhism ) শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রদূত হলেন গুরুভান্তে শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের। তাঁরই উদ্যোগে ও নেতৃত্বে অনাথ, অসহায় ও দুঃস্থ শিশুদের শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালে দীঘিনালায় বোয়ালখালীতে পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ১৯৭৪ সালে তাঁরই নির্দেশে ও আর্থিক সহযোগিতায় রাঙ্গামাটিতে রাঙ্গাপানি গ্রামে মোনঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সময় বোয়ালখালী পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম বিলুপ্ত হয়ে গেলেও মোনঘর সগৌরবে টিকে আছে। পাহাড়ের আনাচে কানাচে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় মোনঘর আজ ‘শিক্ষার বাতিঘর’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।

কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেমন চট্টগ্রাম, জয়পুরহাট ও রংপুরেও তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

সদ্ধর্মাদিত্য শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয় ১৯৫৮ সালে বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন। বর্তমান মহালছড়ি উপজেলাধীন মুবাছড়ি গ্রামের সদ্ধর্মপ্রাণ দায়ক বিন্দু কুমার খীসার আমন্ত্রণে ঐ গ্রামের বিহার অধ্যক্ষ হিসেবে এসেছিলেন। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়ে গেলে মুবাছড়ি বৌদ্ধ বিহার পানিতে তলিয়ে যায়। তারপর শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয় বিহার অধ্যক্ষ হিসেবে দীঘিনালাস্থ বোয়ালখালী দশবল রাজ বৌদ্ধ বিহারে গমণ করেন।

তিনি খুব কাছে থেকে পাহাড়ি মানুষের সমাজ পরিবর্তন ও দুঃখ দুর্দশার চিত্র দেখেছিলেন। কাপ্তাই বাঁধের অভিঘাত স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সমাজের মধ্যে চরম দারিদ্র্য, জীবন জীবিকার চরম অনিশ্চয়তা ও শিক্ষাহীনতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এতিম ও দুঃস্থ শিশুদের চরম দুঃখ দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

এ অবস্থায় বৌদ্ধ ভিক্ষু হলেও তিনি নিজেকে সমাজ বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। মহা কারুণিক গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা “বহুজন হিতায, বহুজন সুখায” – বহু জনের কল্যাণের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য তিনি সমাজ সম্পৃক্ততামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বৌদ্ধধর্মের মৈত্রী-করুণা-মুদিতার ধারনাকে সমাজ জীবনে প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন সফলভাবে। ধর্ম, নৈতিক শিক্ষার প্রসার তথা সমাজের দারিদ্র্য, কুশিক্ষা, কুসংস্কার ইত্যাদি দূর করবার লক্ষ্যে তিনি শিক্ষাকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাই তো নৈতিক শিক্ষার জন্য পালিটোল/পালি কলেজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষাকে। সাধারণ শিক্ষা গ্রহণকে ভিক্ষু-শ্রামণদের জন্যও উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ধর্মের চেতনার সাথে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণের মধ্যে কোন বিরোধ দেখেননি। বরং দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করে ধর্ম শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার উন্নয়নকে সমানতালে এগিয়ে নিয়েছিলেন।

পরমপূজ্য গুরুভান্তে শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয়ের দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা ও প্রায়োগিক জ্ঞানের বদৌলতে পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম ও মোনঘরের মত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পেয়েছি। তাঁর সুযোগ্য শিষ্য হিসেবে আমরা পেয়েছি কর্মবীর শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ বিমল তিষ্য মহাথের, শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাথের, শ্রীমৎ শ্রদ্ধালংকার মহাথের মহোদয়ের মত স্বনামধন্য ব্যক্তিদের। তাঁরা তাদের কর্মের মাধ্যমে স্বমহিমায় ভাস্বর। গুরুভান্তে শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয় না থাকলে হয়তো আমরা এসব কর্মবীর আমাদের সমাজে পেতাম না।

শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয়ের স্বেচ্ছাসেবী সমাজ কল্যাণমূলক কাজ সহজসাধ্য ছিলো না। তিনি দান-দক্ষিণার পাশাপাশি সাধারণ গ্রামবাসীদের নিকট হতে মুষ্টিভিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। পাশাপাশি গ্রামের মানবতাবাদী বিত্তবান পরিবারসমূহের কাছ থেকে মাসিক দান (চাল) এবং ভিক্ষুসংঘের নিকট হতে এককালীন দান ইত্যাদি দিয়েই অনাথ ও দুঃস্থ শিশুদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন। মুষ্টিভিক্ষা ও সাধারণ দায়ক-দায়িকাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দান সদ্ব্যবহার করতে পারলে সেটা কত যে ফল দিতে পারে, সেটার প্রকৃত উদাহরণ হলো পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ ও মোনঘর।

পরম পূজ্য গুরুভান্তে শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের ১৯৬১ সালে যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন, সেটা আজ মহীরূপে পরিণত হয়েছে। ফুলে ফলে ভরে উঠেছে চারদিকে। পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম ও মোনঘরে অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থীরা কেবল বাংলাদেশে নয়, বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সরকারি, বেসরকারি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেশ ও সমাজের উন্নয়নে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তারা সমাজ ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয়ের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পাহাড় ও সমতলে সমান তালে আলো দিয়ে যাচ্ছে।

১৯৬১ সাল থেকে ২০২২। ৬১ বছরের কর্মযাত্রা। আজকে ‘একুশে পদক ২০২২’-এর মাধ্যমে পরম পূজ্য গুরুভান্তে শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয়ের সেই মহান আত্মত্যাগ ও কর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। তাঁর এই স্বীকৃতিতে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত।

পরম পূজ্য গুরুভান্তের বয়স এখন ৯৭। প্রাকৃতিক নিয়মে জরাধর্ম তাঁর শরীরকে পরাস্ত করার চেষ্টা করলেও তাঁর মনের জোরকে থামাতে পারেনি। সমাজের কল্যাণে তাঁর কর্ম স্পৃহা অদম্য, অজেয়। তিনি নিরোগ হয়ে আমাদের আশীর্বাদ দিন।

এই শুভ মুহুর্তে পরম পূজ্য গুরুভান্তে শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয়ের প্রতি সশ্রদ্ধ বন্দনা জানাচ্ছি।

 

মোনঘর পরিবারের পক্ষ থেকে

অশোক কুমার চাকমা

নির্বাহী পরিচালক

মোনঘর

মন্তব্য...

comments

আরো নিউজ ও ইভেন্ট